এম. মাহবুব আলম: গত ২৫ নভেম্বর পোশাক শিল্পে নিযুক্ত সকল শ্রমিকদের জন্য সরকার মজুরী গেজেট প্রকাশ করেছেন, যেখানে ন্যুনতম মজুরী থেকে শুরু করে উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত ও প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত উভয়ের জন্যই “ক” ও “খ” পরিচ্ছেদ নামে গ্রেড ভিত্তিক নতুন মজুরী কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে। শুরুতে খুশি থাকলেও কিছুদিন পরেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।
এর কারণ কি??? জানামতে ও কিছুটা পর্যালোচনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিছুটা লিখছি। লেখার আগেই এই মজুরী বৃদ্ধি নিয়ে আইন বিধি কি বলে সামান্য কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।
মজুরী বোর্ড ও মজুরী ঘোষণা
কোন শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকের জন্য স্থিরকৃত ন্যুনতম মজুরীর হার সরকারের নির্দেশক্রমে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুনঃনির্ধারণ করিতে পারিবে। {ধারা ১৩৯ উপ-ধারা(৬)}
ধারা ১৩৯, ১৪০ ও ১৪২ এ যে বিধানই থাকুক না কেন, বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকার কোন শিল্প সেক্টরের জন্য ঘোষিত নিম্নতম মজুরী কাঠামো বাস্তবায়নের যে কোন পর্যায়ে নূতনভাবে নিম্নতম মজুরী কাঠামো ঘোষণার জন্য নিম্নতম মজুরী বোর্ড পুনঃগঠন এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনরায় নিম্নতম মজুরী হার ঘোষণা করিতে পারিবে।
তবে শর্ত থাকে যে, সরকার প্রয়োজন মনে করিলে, প্রজ্ঞাপন ছাড়াও শ্রমিক ও মালিক পক্ষের সাথে আলোচনাক্রমে চলমান মজুরী হারের কোন সংশোধন বা পরিবর্তন কার্যকর করিতে পারিবে। (ধারা ১৪০ক)।
সুপারিশ প্রণয়নে বিবেচ্য বিষয় – কোন সুপারিশ প্রণয়ন করা কালে মজুরী বোর্ড জীবন যাপন ব্যয়, জীবন যাপনের মাণ, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মাণ, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনা করিয়া দেখিবে। (ধারা ১৪১)।
এখানে যেসব সুপারিশ বিবেচনার কথা বলা হয়েছে, বিগত মজুরী বোর্ড অবশ্যই সেসব বিবেচনা করেছেন এবং সকল পক্ষের সাথে আলোচনা করেই মজুরী নির্ধারণ করেছেন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়।
সমস্যা টা হচ্ছে মজুরী কাঠামোর মূল বিষয় বুঝতে না পারা, যেমন –
প্রথমত – আমরা বাঙ্গালীরা অপরের ভালো দেখতে পারিনা এখানেও সেরকম কিছু ঘটেছে, বুঝিয়ে বলছি ধরুন একজনের বেতন ছিলো ৬৪২০/ টাকা তিনি বর্তমান কাঠামো অনুযায়ী বেতন পাবেন ৯২৪৫/ টাকা (যদি সে গ্রেড ৪ এর শ্রমিক হোন), আরেকজনের বেতন ছিলো ৮০০০/ টাকা (যদি সে গ্রেড ৪ এর শ্রমিক হোন),এখানে একজনের বেতন বেড়েছে ২৮২৫/- টাকা আরেকজনের বেড়েছে ১২৪৫/- টাকা। এখন যিনি ১২৪৫/- টাকা পেয়েছেন তার প্রশ্ন আমরা একই কাজ করি তাহলে ওর ২৮২৫/- টাকা বাড়লে আমার ১২৪৫/- টাকা কেন বাড়বে।
দ্বিতীয়ত – গার্মেন্টস সেক্টরে যাদেরকে হেলপার বা সহকারী অপারেটর বলা হয় এদের বেতনের সাথে অপারেটরের বেতনের দূরত্ব অনেক কম, এটি যেখানে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার পার্থক্য থাকা উচিৎ সেখানে সর্বশেষ গেজেটেও পার্থক্য মাত্র ৪০৫/- টাকা, এরফলে দিনে দিনে যেমনি অপারেটর তৈরি হচ্ছেনা তেমনি বৈষম্যও দেখা দিচ্ছে এবং এতে অপারেটররা ক্ষিপ্ত হচ্ছেন।
তৃতীয়ত – সবচেয়ে বড় কারণ প্রতিষ্ঠান ভেদে বেতনের বৈষম্য, বিশেষ করে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের ফ্যাক্টরির মধ্যে বেতনের ব্যবধান অনেক বেশি এবং কেউ কেউ একথাও বলতে যাচ্ছেন যে আজকের এই অচলাবস্থার জন্য ঢাকার বাইরের কারখানার মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষই দায়ী, যেমন – বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ঢাকায় যে অপারেটরের বেতন ৮০০০/- টাকা ঢাকার বাইরে তার বেতন কমপক্ষে ৯৫০০/- টাকা, এটা কেন হয়েছে পরে বলছি আগে সমস্যা কি হয়েছে সেটা বলছি, এই বেশি বেতন থাকার কারণে বর্তমান মজুরী কাঠামো অনুযায়ী তার বেতন খুব একটা বাড়েনি যেমন বর্তমানে যে অপারেটর ৯৫০০/- টাকা বেতন পান তিনি যদি গ্রেড ৩ এর অপারেটরও হোন তার বেতন হবে ৯৫৯০/- টাকা তাহলে বাড়লো ৯০/- টাকা আর মজুরী কাঠামোর পরিবর্তিত সূত্র অনুযায়ী বেসিক ঠিক রাখতে যা বাড়বে, এরফলে দেখা যাচ্ছে তার বেতন অনেক কম বাড়ছে এবং তাতেই এই শ্রমিক বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। এই অবস্থা কেন হয়েছে এর কারণ হচ্ছে প্রতিযোগিতা করে বিভিন্ন কারখানায় বিভিন্নভাবে বেতন নির্ধারণ করা, পূর্বের গেজেট মেনে না চলা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা যেমন কোন শ্রমিক যদি চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন তাহলে তার সার্ভিসবুক তাকে দিয়ে দেয়ার কথা কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেয়া হচ্ছেনা অথচ এই নিয়ম মানলে যখনই কোন শ্রমিক এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হতো সার্ভিসবুক দেখেবেতন সামঞ্জস্য করা যেতো কিন্তু এটি হচ্ছেনা বিধায়ই এই বৈষম্য। এখন এই সমস্যার কারণে ঢাকার বাইরে থেকেই গোলযোগ শুরু এবং বেশি গোলযোগ সেখানেই যেটি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পরছে সর্বত্র।
কিন্তু ঢাকায় বেতন বেশি হওয়া উচিৎ আর বাইরে কম কেননা ঢাকায় বাড়িভাড়া বেশি দ্রব্যমূল্য বেশি অথচ বেতন ঢাকার বাইরে বেশি, অজুহাত একটাই ঢাকার বাইরে লোকজন যেতে চায় না। কারো সুবিধা অসুবিধার জন্য প্রশাসনিক কাঠামো ভাঙ্গা যায়না, নিয়মনীতি বাদ দিয়ে দেয়া যায়না, নিয়মনীতি ঠিক রাখেন দেখবেন সব ঠিক, বেশীরভাগ ফ্যাক্টরি ঢাকার বাইরে চলে গেছে শ্রমিকরা ঢাকার বাইরে না গিয়ে যাবে কোথায়, আপনি যদি আপনার নিয়মনীতি থেকে সরে যান অন্যরাও সরে যাবে যার প্রতিফলন এখন দেখছি।
চতুর্থত – নতুন শ্রমিকদের বেতন নির্ধারণে বৈষম্য, সবসময়ই খেয়াল রাখতে হবে যতো দক্ষ অপারেটরই হোক না কেন যেকোন প্রতিষ্ঠানে তার পুরানো শ্রমিকদের সাথে সমন্বয় করে নতুন নিয়োজিদের বেতন নির্ধারণ করতে হয় তাহলে এই গেজেট প্রকাশের সময় ঝামেলা কম হয়, যেমন ধরুন ২০১৩ সালের গেজেটে গ্রেড ৪ এর বেতন ছিলো ৬৪২০/- টাকা, চারটি ইনক্রিমেন্ট পাওয়ার পরে তার বেতন হওয়ার কথা ৭৫৬৬ টাকা কিন্তু দেখা যাচ্ছে এক কারখানা থেকে আরেক কারখানা এক লাইন থেকে আরেক লাইন এভাবে করতে করতে সেই বেতন ৮৫০০ থেকে ৯০০০ টাকায় পৌঁছে গেছে কোথাও কোথাও তারও বেশি কিন্তু যিনি একই কারখানায় এতো বছর রয়ে গেছেন তার বেতন সেই ৭৫৬৬ টাকায়ই আছে, এখন নতুন গেজেটে ৭৫৬৬ এর বাড়ছে ১৬৭৯ টাকা আর যিনি এই ফ্যাক্টরি ঐ ফ্যাক্টরি করেছেন তার বেড়েছে ৯৩৪/২৪৫ টাকা, এখন এই ফ্যাক্টরি পরিবর্তন করারাই বেশি ঝামেলা করছে কিন্তু তিনি যে আগে থেকে বেশি নিয়েছেন সেটি খেয়াল করছেন না। এজন্য উল্লেখযোগ্য সমাধান হচ্ছে নিয়োগের সময় অবশ্যই আগে থেকেই নিয়োজিত শ্রমিকদের একই গ্রেডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন ধরতে হবে তাহলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর এই ঝামেলায় অন্তত পরতে হবেনা।
পঞ্চমত – শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সম্বন্ধে তারা নিজেরাই জানেননা, অনেকের সাথেই কথা বলে জানা গেলো অনেক অভিমত, বেশীরভাগই হুজুগে কারখানা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, অন্যরা বের হচ্ছে তাই তিনিও, কখনো কখনো আবার কারো প্ররোচনায়। যারফলে নিয়মিত তাদের কাউন্সিলিং দরকার কিন্তু বেশীরভাগ কারখানায়ই এই কাউন্সিলিং নেই বললেই চলে, কোনোরকম কোনো প্রশিক্ষণ এর জন্য শ্রমিক ডাকলেই মালিক বা উৎপাদন কর্মকর্তাদের চক্ষু চরগগাছ কিন্তু তারা এটুকু বুঝতে চান না যে এই ট্রেইনিং এর ফলে তাদের উপকারই হয় ক্ষতি নয়, এরচেয়েও বেশি দরকার শ্রমিকদের বোঝা যে আমি পাচ্ছি কি, আমি চাচ্ছি কি আর আমার পাওয়া উচিৎ কি।
ষষ্ঠত – মজুরী কাঠামোর পরিবর্তিত সূত্র, ২০১০ সালের গেজেটের বাড়িভাড়া বেসিকের ৩০%, ২০১৩ সালে ৪০% আর ২০১৮ সালে ৫০% এবং অন্যান্য যেখানে ১১০০ টাকা ছিলো সেটা এখন ১৮৫০, এরফলে বেসিক কমে গিয়েছে, বেসিক কমে গিয়ে ও.টি রেট যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়েনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে একই আছে আবার অনেকে বেসিকের উপর ভিত্তি করে বোনাস বা আনুষঙ্গিক পাওনা দিয়ে থাকেন কিছু সুযোগ সন্ধানীরা এটাই শ্রমিকদেরকে বুঝিয়েছেন যে তাদের বেতন কমে যাওয়ার কারণে এসব সুযোগ সুবিধা কমে যাবে।
সপ্তমত – এই সকল গোলযোগের উপঢৌকন হিসেবে কাজ করে কতিপয় নামধারী শ্রমিক নেতারা, যিনি কোনদিনই শ্রমিক ছিলেন না কিন্তু নেতা বনে গেছেন, এখন কমিশন ঠিকভাবে না পেলেই উস্কানি দিতে থাকেন আর সময় সুযোগ খোঁজেন কিভাবে অস্থিতিশীল করা যায় এই সেক্টর, সাথে যদি বিদেশী পয়সা আর মদদ থাকে তাহলেতো আরো একধাপ এগিয়ে তারা।
অষ্টমত – মজুরী বোর্ডে প্রকৃত শ্রমিক নেতা না থাকা, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও সুবিধা পাওয়ার আশায় সেখানে দলীয় শ্রমিক নেতারা যুক্ত থাকেন (এটি প্রত্যেকটি মজুরি গেজেটেই দেখা গেছে) যার ফলে শ্রমিকদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাওয়ার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা থাকেনা আর এই দেশে সবকিছুরই প্রকৃত খোঁজা একটু দুষ্করই বটে।
নবমত – আন্দোলনের সঠিক নিয়ম না জানা, যেমন শ্রমিকদের আন্দোলনের একমাত্র পন্থা হচ্ছে কর্মবিরতি কিন্তু তারা সেটা না করে ভাংচুর করছে কারখানার বাইরে বেড়িয়ে গিয়ে অন্য কারখানায় আঘাত হানছে যেটি কোনভাবেই কাম্য নয়। এখানেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই তাদেরকে এ বিষয়টি বুঝাতে হবে কিন্তু মালিক পক্ষের ভয় যদি শ্রমিকদের এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাহলে তারা আন্দোলনে ঝুকবে কিন্তু ভাঙচুরের চেয়ে যে কর্মবিরতি ভালো এটিও মালিক পক্ষকে বুঝতে হবে।
যদি সম্ভব হয় পাওয়া যেতে পারে সমাধান – প্রতি পাঁচ বছর অন্তর মজুরি গ্রেড নতুন নতুনভাবে নির্ধারিত হয় এর মাঝে প্রতি বছর ৫% হারে মজুরি বাড়ে, এখন যদি এভাবে করা যায় যে প্রতি বছর ৫% হারে বাড়বে আর পাঁচ বছর পরে এরচেয়ে শতকরা বেশি হারে বাড়বে সেটা ১০,১৫,২০ যেকোনোটাই হতে পারে, এরফলে একজন থেকে আরেকজনের বেতনের যে পার্থক্য ছিলো সেটি বজায় থাকবে এবং ঝামেলাও কমতে পারে।
বাংলাদেশের পোষাক খাত একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, আস্তে আস্তে পোশাকের তৈরি মূল্য কমে যাওয়া, পোশাক তৈরির সরঞ্জামাদির দাম বৃদ্ধি পাওয়া এবং দক্ষ শ্রমিকের প্রকট অভাব, সেই মূহুর্তে যদি এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে দিনে দিনে পোশাক খাত আরো সঙ্কুচিত হয়ে যাবে আর যে খাতটি থেকে ৮০/৮৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় সেটি যদি সঙ্কুচিত হয়ে যায় তাহলে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার উপরে কি ধরণের প্রভাব পরবে তা বলাই বাহুল্য। তাই এখনই সময় শ্রমিকদের সঠিক বিষয় জেনে অহেতুক কোন গোলযোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখার আর কর্মস্থলে সঠিকভাবে কাজ করার সাথে সাথে এটা ভাবা যে প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিনিয়োগের ফলেই পোশাক খাতের আজকের অবস্থান আর মালিক পক্ষকেও ভাবতে হবে বিনিয়োগের পাশাপাশি শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই পোশাক শিল্প আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
এগিয়ে যাক পোশাক খাত, এগিয়ে যাক সেলাই দিদিমণি, দাদাভাই এই শুভকামনায়।।
লেখক – এম. মাহবুব আলম, ম্যানেজার (এইচ আর এন্ড কমপ্লায়েন্স)
ইউনিফর্ম টেক্সটাইল লিমিটেড
মতামত লিখুন :