Logo

সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা ও আমাদের পোশাক শিল্প : ঘুরে দাড়াবেই বাংলাদেশ

Fazlul Haque
মঙ্গলবার, জুলাই ১২, ২০১৬
  • শেয়ার করুন

আব্দুল আলিম : ব্লগার রাজিব ও ইটালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু টার্গেট কিলিং চলেছে। মূলত টার্গেট ছিল বিদেশি নাগরিক, দেশের ভিন্ন সম্প্রদায়ের নাগরিক ও মুক্তমনা লেখক সমালোচকগণ।অধিকাংশ ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র সাথে থাকার পরও মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে।হামলাগুলির ধরণ ও টার্গেট দেখে অনেকেই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সন্দেহ করে করেছেন। এ সন্দেহ পরিষ্কার হয়ে যায় নারকীয় গুলশান হামলার মাধ্যমে। দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা জানার আগেই হতাহতের সংখ্যাসহ এ হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে একটি জঙ্গি সংগঠন। তবুও সরকারের পক্ষ থেকে চলছে নানা তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ। এ হামলা যে সংগঠনই করে থাকুক তারা উগ্রবাদী সংগঠন। এসব সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য ইসলাম কায়েম করা কিনা তা আমরা সঠিক জানি না। তবে এসব হামলায় সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেল এ দেশের অর্থনীতির, বিশেষ করে রপ্তানি শিল্প এখন ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।

১৯৫২ তে হারেনি, ১৯৭১ এ হারেনি, কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের পোশাক খাতকে ধ্বংস করা যায় নি। তাজরিন ফ্যাশনের দুর্ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, রানা প্লাজা আমাদের সমগ্র পৃথিবীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তবুও শত বাঁধা পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, জিএসপি বাতিল করেও আমাদের দমানো যায়নি। এতো সফলতার পরে বিপথগামী জঙ্গিদের হামলায় কি থমকে যাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা? বাঙ্গালী হেরে যেতে শিখেনি কখনও। বাংলাদেশ কে হারাতে পারবে না কোন শক্তি। গুলশানের ওই ৪/৫ জনই বাংলাদেশ নয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে বাংলাদেশকে।

২০২১ সালের স্বপ্নের ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি বাজার আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই খাতে সরাসরি ৪০ লাখ লোক কাজ করে এবং কমপক্ষে আরও দেড় কোটি লোক এই পোশাক খাতের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সবচেয়ে বেশি কর্ম সংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই খাতে। ইতিমধ্যে নিম্নমধ্যবিত্ত দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে আমাদের দেশকে।

রপ্তানী কার্যক্রমের কয়েক ধাপে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সাক্ষাতের প্রয়োজন হয় বলে আমাদের দেশের পোশাক কারখানা মালিকদের প্রচুর বিদেশ ভ্রমণ করতে দেখা যেত। বিশেষ করে আমেরিকা ইউরোপ এর ক্রেতারা হংকং পর্যন্ত আসতো এবং তাদের সাথে দেখা করতে আমাদের যেতে হত হংকং। এভাবেই অধিকাংশ ক্রেতা তাদের এশিয়ান আঞ্চলিক অফিস করে হংকং এ। এমনিতেই সামান্য মার্জিনের ব্যবসায় ববসায়িক মিটিং এর নামে খরচ হয়ে যেত আরেকটি অংশ। গত ১০ বছরে সেই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে অনেক। এখন ক্রেতারাই চলে আসছেন বাংলাদেশে। গড়ে উঠেছে প্রচুর ছোট বড় হোটেল। প্রায় সকল হোটেল ভাল ব্যবসা করছে। তাঁর মানে আমাদের আগের খরচ কমে এখন ক্রেতারা আমাদের দেশে খরচ করছেন। পোশাক খাতের একটি বাই প্রোডাক্ট হিসেবে দ্রুত উন্নয়ন ঘটে হোটেল ও পর্যটন ব্যবসায়। প্রতিনিয়ত আমাদের দেশ ভ্রমণ করেন পৃথিবীর নানা দেশের মানুষ। কেউ বা আসেন পোশাক কিনতে, কেউ বা আসেন মেশিন বিক্রি করতে আবার কেউ বা আসেন আমাদের উন্নয়ন সহযোগী (GIZ, JICA, USAID, DANIDA) হয়ে। প্রতিটি বিদেশির বাংলাদেশ ভ্রমণ আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রসারের কারণে হাজারো ছোট ছোট হোটেল মোটেল হয়েছে যারা সফলভাবে লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপক অবদান রেখেছেন চলেছেন এদেশের অর্থনীতিতে। গুলশান হামলার পর হোটেলগুলিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বুকিং বাতিল হয়েছে। ইউরোপ ভিত্তিক উদ্যোগ “বিএসসিআই” তাদের ৭ দিনব্যাপি  আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ ঢাকা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেছে। এমন ঘটনা অনেক অনেক। তাঁর মানে সরাসরি আঘাত এসেছে দেশের অর্থনীতিতে।

২০২১ সালের মধ্যে আমাদের স্বপ্ন ২৬ বিলিয়নকে ৫০ বিলিয়নে উন্নিত করা। এই পোশাক খাত যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল তাতে ৫০ বিলিয়ন খুব বেশি কাল্পনিক ছিল বলে মনে হয় না। তবে রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনের কারনে অ্যাকর্ড/এলায়েন্স এর নামে ব্যাপক ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই গুলশানের আর্টিজান হামলা যেন পোশাক খাতকেই হামলা করেছে। হামলায় টার্গেট পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতা, বিনিয়োগকারীসহ অকৃত্রিম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র জাপানের উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। ১৭ বিদেশীর ৯ জনই ইটালির নাগরিক। এদেরই একজন বাংলাদেশকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিয়েছেন দীর্ঘ ২১ বছর। এদেশেই প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর পোশাক কারখানা। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছেন হাজারো বাংলাদেশির। তাকেও জীবন দিতে হল আমাদের কোন বাংলাদেশির হাতে নির্মম ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেক স্তম্ভ হল শ্রম বাজার। ইউরোপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারও ইটালি।

হুশি কোনিও হত্যার পর গুলশানের হামলায় আবারও ৭ জাপানি নাগরিককে জীবন দিতে হল যারা সবাই এসেছিলেন আমাদের স্বপ্নের মেট্রোরেল প্রকল্পে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে। বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণ করতে এসে দুঃস্বপ্নের ভয়াল সেই রাতে একসাথে চিরবিদায় নিয়েছেন অস্বাভাবিকভাবে। জাপান তাদের উন্নয়ন কর্মসুচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আমাদের কিছুটা আশান্বিত করলেও প্রভাব পরতে পারে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায়।

২০০৫ সালে কোটা সিস্টেম উঠে যাওয়ার পর এ দেশ থেকে পোশাক শিল্প চলে যাবে বলে অনেক নামকরা অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। কিন্তু আমাদের এই খাতের সংশ্লিষ্ট সকলের কঠোর পরিশ্রম আর মেধার কারনে ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি নিয়েই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের পোশাক খাত। ২০০৪-০৫ সালের পোশাক রপ্তানীর পরিমাণ ৬৪১৭.৬৭ থেকে বেড়ে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক খাত।

২০১২ সালের তাজরিন ফ্যাশনের অগ্নিকান্ডের পর অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন এবার বুঝি বাংলাদেশ শেষ। ক্রেতাদের নানান তৎপরতা যখন চলছে ঠিক তখনি বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ কারখানা দুর্ঘটনা ঘটে যায় বাংলাদেশে। কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করা অবস্থায় ধ্বসে পরে রানা প্লাজা। ঝরে যায় ১১২৯ টি তাজা প্রাণ। এ যেন টর্নেডো এর আঘাত আমাদের প্রানের পোশাক খাতে। সারাবিশ্ব মানবতাকে নাড়া দেয় এই ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাও প্রথম ও একমাত্র ঘটনা। হেলে যাওয়া বা সামান্য দেবে যাওয়ার ঘটনা শুনেছি তবে আর কোনদিন এভাবে কোন বহুতল ভবন গুঁড়িয়ে যায়নি। পর পর দুটি দুর্ঘটনা আমাদের পোশাক খাতকে এক চরম সঙ্কটে ফেলে দেয়। ভবন গুঁড়িয়ে যাবার খবরে মনে হয়েছিল আমাদের এই বিশাল খাতটিই যেন ধ্বসে গেল। কয়েকমাস ব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা শেষে কারখানা নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে দুটি উদ্যোগের কথা উঠে আসে। সরকার ও মালিক পক্ষ শুধুমাত্র এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে ভিন্ন দেশের ব্যবস্থাপনায় ইউরোপিয় ক্রেতাদের উদ্যোগে অ্যাকর্ড ও মার্কিন ক্রেতাদের উদ্যোগে গঠিত এলায়েন্স মেনে নেয়। দেশের নিয়মে ও কিছু অনিয়মে চলতে থাকা এই খাত প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়। চাপিয়ে দেয়া হয় আরেক দেশের অগ্নি নিরাপত্তা আইন। অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রেসক্রিপশন পুরনে ব্যর্থ হয়ে বন্ধ হতে শুরু করে একের পর এক কারখানা। নিরীক্ষণ ও ফরমায়েশ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠলেও সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মত আমাদের অর্থনীতিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই পোশাক খাতকে বাঁচাতে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই খাত সংশ্লিষ্ট সকলে। সংকট মুহূর্তে প্রতিবেশী দেশগুলির তীব্র প্রতিযোগিতা, শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধির চাপ, সরকারের উৎসে কর বাড়ানোর (পরে আর বাড়ানো হয় নি) প্রস্তাব, ক্রেতাদের নতুন নতুন দেশের প্রতি আকর্ষণ ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের আরও বেশি দরকষাকষির মত চেলেঞ্জ মোকাবেলায় এই খাতের কান্ডারিরা যখন গলদঘর্ম ঠিক সেই মুহূর্তে জঙ্গি হামলা আঘাত হানল গুলশানের একটি ক্যাফে তে। পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট ৯ ইটালিয়ান নাগরিকসহ ২০ জন ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। দুঃসংবাদ নেমে আসে দেশের সবচেয়ে বড় এই শিল্প খাতে।

১৯৫২ তে হারেনি, ১৯৭১ এ হারেনি, কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়েছে আমাদের পোশাক খাতকে ধ্বংস করা যায় নি। তাজরিন ফ্যাশনের দুর্ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, রানা প্লাজা আমাদের সমগ্র পৃথিবীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তবুও শত বাঁধা পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, জিএসপি বাতিল করেও আমাদের দমানো যায়নি। এতো সফলতার পরে বিপথগামী জঙ্গিদের হামলায় কি থমকে যাবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা? বাঙ্গালী হেরে যেতে শিখেনি কখনও। বাংলাদেশ কে হারাতে পারবে না কোন শক্তি। গুলশানের ওই ৪/৫ জনই বাংলাদেশ নয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়াতেই হবে বাংলাদেশকে।

লেখক : সম্পাদক, দি আরএমজি টাইমস